![]() মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর
|
এর মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার তোপ বাংলাদেশকে আঘাত করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই বিপুল শরণার্থীদের আশ্রয় দান করেছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণ খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী এই শরণার্থীদের জন্যে সংগ্রহ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নিশ্চয়তাও প্রদান করেছেন যে, কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্ষুধা, তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করবে না। শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে শুরু করেছে। কিন্তু সবকিছুর ওপরে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এই রোহিঙ্গাদের দ্রæত প্রত্যাবর্তন ও শান্তিপূর্ণ পুনর্বাসনই প্রধান উদ্বেগ হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও দু’তিন পুরুষ ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে বসবাসের পরেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার বঞ্চিত রয়েছে। এ পর্যন্ত মিয়ানমারের বৌদ্ধ-সামরিক জান্তা ও পরবর্তীতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে রোহিঙ্গাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন আশা করেছিল। কিন্তু তাদের নেই আশা অধরাই থেকে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্ত খোলা রাখার এবং আর্মি ও সীমান্ত রক্ষীদের কোনো প্রকার কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশের কারণে এখনো প্রতিদিন নাফ নদী দিয়ে হাজারো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এটি ছিল শেখ হাসিনার একটি দৃষ্টান্তপূর্ণ মানবিক সিদ্ধান্ত। তার এই যুগান্তকারী উদারতা তাকে মানবতার মাতার সম্মানজনক উপাধি এনে দিয়েছে এবং বিশ্ব নেত্ববৃটিশন্দকে রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারকে এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্যেও বিশ্ব নেতৃবৃটিশন্দ চাপ প্রয়োগ করছে যা এখন নেপিদোকেই সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চলতে থাকা চলমান সমস্যায় জাতিসংঘের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র যেমন; চীন, রাশিয়া এবং ভারত মিয়ানমারের পক্ষ নিচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এই রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশেবিভিন্ন উদ্দেশ্যের প্রতি সমর্থনশীল হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এরই প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক সম্প্রদায়গুলো তাদের সাহায্যার্থে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসে। এই মানুষগুলোর প্রতি সকলে সহানুভূতিশীল হওয়া সত্বেও কিছু বিশেষ সমস্যা এখনো সমাধান হওয়ার বাকী। কারণ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল হওয়ার পরও এতো বিপুল জনগোষ্ঠীকে বেশিদিন ভরণ-পোষণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিবাদের ইতিহাস অনেক পুরোনো। চল্লিশের দশকে এর সূত্রপাত ঘটে- যদিও অনেকের মতে এর মূল আরো গভীরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা মিত্র (বৃটিশটিশ) বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। এর বিনিময়ে তাদের একটি নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রæতি পেয়েছিল। সামরিক সরকারের অধীনে ও তত্ত¡াবধানে ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা শুরু হয়। তখন বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৮২ সালে এবং ৯০-এর দশকের প্রথমভাগেও একই ধরণের অভিযান চলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। সর্বশেষ এই বছরের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে সামরিক বাহিনী ও সহযোগী বৌদ্ধদের অত্যাচারে নিপীড়িত লাখ লাখ রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নিতে শুরু করে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্য বর্তমানে প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায়, গত ১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিং অন হ্লাইয়াং বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেই কাজে সফল হতে পারেননি, এখন তারা তাতে সফল হয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে রাখাইন রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আয়ত্বে আনতে ব্যর্থতা এবং বর্তমানে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য সফল হওয়াকেই ইঙ্গিত করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে খ্যাত অং সান সু চি উভয়েই তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে অ্যাখ্যায়িত করেন। একথা সত্য যে, রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে কিছু বিদ্রোহ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক সরকার কর্তৃক যে ভয়াবহ বর্বরোচিত হামলা চালোনো হয়েছে তার সঙ্গে কোনো নৃশংসতারই তুলনা হয় না। এর ফলে ৮০-এর দশকে ও ৯০-এর দশকে বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা নিরূপায় হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। চরম নির্যাতিত এই রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তারা সকলেই অশিক্ষিত। তাদের খুব দ্রæত সময়ে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। যেহেতু এই মানুষগুলোকে মিয়ানমারের সামরিক সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই তারা মৌলিক এবং মানবিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত ছিল। এরা কয়েক পুরুষ ধরেই শিক্ষাবঞ্চিত এবং এই কারণেই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বিশ্বের অন্য সকল শরণার্থীদের থেকে চরিত্রগতভাবে আলাদা। একইসঙ্গে মিয়ানমার স্বাস্থ্যসেবায় এই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অনেক অবহেলা ছিল। তাদের অনেকেই অসুস্থ। নির্যাতনের দরুণ অনেকেরই স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি শারীরিকভাবে তাদেরকে আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি হাজার হাজার ধর্ষিত গর্ভবতী নারী থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ শারীরিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। আর এই সমস্যাগুলো রোহিঙ্গাদের কর্মদক্ষতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের এই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ব্যাপক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা প্রদান করতে হবে। শত শত ক্যাম্পের অস্থায়ী ঘরে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন সংস্থা, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি খাদ্য, পানি, তাঁবু, ওষুধপত্র ও অর্থের রূপে সাহায্য প্রেরণ করছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই সাহায্যগুলো তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে যথেষ্ট নয়। তার জন্য খাদ্য ও আশ্রয়স্থলের পাশাপাশি শিক্ষা এবং বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। আমরা দেখেছি যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বেশকিছু মাদরাসা খোলা হয়েছে এবং আমরা এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আমরা একইসঙ্গে উদ্বিগ্ন। কারণ, যারা এই মাদরাসাগুলো পরিচালনা করছে তাদের উদ্দেশ্য আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। এটাও হতে পারে, তারা ছাত্রদের সন্ত্রাসবাদের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে যা আমরা গত কয়েক বছরে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটতে দেখেছি। এ ছাড়াও আইএসআইএস, নব্য জেএমবি ইত্যাদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত মানুষজনকে ভুল ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সন্ত্রাসবাদের দিকে টেনে আনতে টার্গেট করে থাকে। তাই এই রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। এই রোহিঙ্গাদের মাঝে শিশু-কিশোররাই সংখ্যাগরিষ্ট এবং তাদের বেশিরভাগই পিতা-মাতাহীন বা অনাথ। উন্নয়নের রোহিঙ্গাদের আধুনিক শিক্ষা ও সুবিধাসহ স্কুল প্রয়োজন। তাদের শিক্ষাটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি বা বার্মিজ ভাষায় হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু, তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে। আমাদের কখনোই ভোলা উচিৎ হবে না যে, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আনান কমিশনের পরামর্শানুযায়ী দ্রæততম সময়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন। ইউএনএইচসিআর এবং জাতিসংঘের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের উচিৎ বাংলাদেশ সরকার ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সাহায্য নিয়ে রোহিঙ্গাদের স্কুলের জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করা। আর আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোকে এই শরণার্থীদের জন্য শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্কুল স্থাপন ও আনুষঙ্গিক কার্যকমে বিনিয়োগ করতে হবে। যদি তাদেরকে শিক্ষিত করা সম্ভব হয় তবে এই রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার রক্ষায় শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে এবং মিয়ানমারের জন্য সম্পদে পরিণত হবে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য যথাযথ চিকিৎসা সেবা ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক দাতাদের এবং ডবিøউএইচও এবং ইউনিসেফের মতো জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলোকে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকবার জন্য তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যাগুলোকে দ্রæত সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই শরণার্থীদের মৌলিক অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে এবং কঠোরভাবে এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনকে সমর্থন করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা তৈরি করতে শুরু করেছে। এই তালিকাটি সরকারকে একইসঙ্গে ইউএনএইচসিআর এর মাধ্যমে অনুমোদন ও প্রত্যায়ন করে নিতে হবে। কারণ, মিয়ানমার এই তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারে, যা তারা আগেও করেছে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলাদেশে এবং তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে যেন রোহিঙ্গারা তাদের মানবিক অধিকার লাভ করতে পারে। মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর: প্রধান সম্পাদক, মোহাম্মদী নিউজ এজেন্সী |