মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর
Published : Tuesday, 10 October, 2017 at 4:55 PM
বাংলাদেশ বৈচিত্র এবং সাম্যের দেশ। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশে রয়েছে ধর্ম, বর্ণ এবং ভাষা বৈচিত্র। তা সত্বেও প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোকের বসবাস। যাদের মধ্যে ৯০ ভাগই মুসলিম, বাকি ১০ ভাগের মধ্যে রয়েছে হিন্দু, খৃস্টান,  বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের লোক।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভেতরে জাতি, ধর্ম ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কখনো বিঘিœত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙ্গালিদের (নতুন বসতস্থাপনকারী) একত্রে বসবাস করা সম্প্রীতি, শান্তি, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সাম্যের অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং ২০১৭ সাল ছিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত, কিন্তু উৎসব সকলের। শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতি আমাদের গর্ব। ধর্মের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশের জনগণ একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফ’র্তভাবে অংশগ্রহণ করে । হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টানসহ সকলেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। একইভাবে মুসলমানরাও হিন্দুদের দুর্গাপূজা বা খৃস্টানদের বড়দিনে আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। গভীর ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পরস্পরের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এই বন্ধন তৈরি হয়েছে।জাতিগত ভিন্নতা থাকার পরও একে অন্যের প্রতি যে সহনশীলতা বিদ্যমান তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। এই জাতিগত গোষ্ঠীসমূহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। যেমন, উত্তরে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আর পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা, মারমা, মুরং, হাজং ও রাখাইনরা বসবাস করে। যুগ যুগ ধরে পারস্পারিক বোঝাপড়া এবং প্রতিবেশী স্বরূপ সম্প্রীতির সাথে বাঙালিদের সঙ্গেই বসবাস করছে তারা। কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনা, যেমন-পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর বিদ্রোহ, যা শান্তি বাহিনীর সঙ্গে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাধান করেছিলেন। তা ছাড়া সেখানে তেমন কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি।শেখ হাসিনা তার প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে এই চুক্তিটি করেন যা মিয়ানমার সংলগ্ন সুবিশাল দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনে। ফলে সেখানে জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত পার্থক্য সত্বেও, তারা একসঙ্গে জীবনকে উপভোগ করে আসছে এবং অনেক বড় পরিসরে একে অপরের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ করছে।

মুসলমানদের মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে। তাদের মধ্যে শতকরা তিনভাগ শিয়া রয়েছে, বাকীদের অধিকাংশই সুন্নি। মুসলিম বিশ্বে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিশ্বাস ও প্রথাগত পার্থক্যের জন্য ব্যাপক দ্ব›দ্ব বিরাজ করছে। এই দ্ব›েদ্বর দরুণ নানা স্থানে যুদ্ধ পর্যন্ত চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে সুন্নিরা সংখ্যায় সংখ্যাগুরু হলেও শিয়াদের কে নো সমস্যার বা নিপীড়ণের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। বরং শিয়ারা সুন্নিদের সহায়তায় তাদের আচার অনুষ্ঠানগুলো নির্বিঘেœ পালন করেতে পারছে । সত্যিকার অর্থে একজন মুসলিম শিয়া বা সুন্নি কি না, তা নিয়ে আমরা কখনোই মাথা ঘামাই না। এমনকি ধর্মীয় নেতারাও  এই পার্থক্য নিয়ে কখনো তেমন কিছু বলেন না। এটি আমাদের প্রিয় মাতৃভ’মিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম উদাহরণ।

এখানে উল্লেখ্য যে, চারিত্রিকভাবে আমরা সব সময়ই অন্য ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটা আমাদের ঐতিহ্য যে, আমরা বিভিন্ন গোত্রের লোকদের জানতে ও সাহায্য করতে বেশ উৎসাহী। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারীদের মধ্যে বন্ধন আমাদের দেশে অনেক মজবুত এবং এটাই বাংলাদেশের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে বিভিন্ন ধর্মের লোকদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান সবাইকে যে কোনো ধর্ম গ্রহণ, চর্চা ও পালন করার অধিকার দিচ্ছে। সংবিধান আরো বলে যে, প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তার নিজস্ব ধর্মীয়  প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা  করার অধিকার রয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র কখনোই তার নাগরিকদের মধ্যে  ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ ও জন্মস্থান ভেদে কোনো প্রকার বৈষম্য করবে না। স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর তেমন কোনো বড় ধরণের ধর্মীয় বা জাতিগত আঘাত আসেনি।

বাংলাদেশ তার অমলিন সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য সকল রাষ্ট্রের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আইনপ্রয়োগকারী সকল কর্তৃপক্ষ সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো হামলা প্রতিরোধে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। এবং এই ব্যাপারে তারা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করার জন্যে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, যার ফলে মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দু এবং বৌদ্ধদের সংঘাতের কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ওই সকল ঘটনা খুব দ্রæত সময়ে শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের ভেতর এই ঘটনাগুলো ঘটে কিন্তু তা কোনো সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

চলতি বছর ইতিমধ্যে অনেকগুলো ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। যেমন, মুসলমানদের ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা, হিন্দু ধর্মাম্বলীদের জন্মাষ্টমী এবং দুর্গাপূজা, খৃস্টানদের ইস্টার সানডে, বৌদ্ধ ধর্মাম্বলীদের বৌদ্ধ পূর্ণিমা এবং প্রবারণা পূর্ণিমা ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার ফলে এই সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো চলাকালে প্রশাসন সম্পূর্ণ  সফলভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করে। এসব অনুষ্ঠানগুলো আনন্দের সঙ্গে ধুমধাম করে উদযাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, এ বছরের দুর্গাপূজা উদযাপনের বিষয়টি, যেখানে সারা দেশে ৫০০০ এরও বেশি পূজা মÐপ তৈরি করা হয়েছিল যা অন্য যে কোনো বছরের থেকে অনেক বেশি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে যার ফলে সারা বাংলাদেশেই শান্তিপূর্ণ আনন্দঘন পরিবেশ বজায় ছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শিয়া মুসলমানরাও শান্তিপূর্ণভাবে আশুরা পালন করেছে। সরকারের কঠোর তত্বাবধানে ষড়যন্ত্রকারীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের সকল পরিকল্পনা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। জনগণের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় প্রধানসন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ট ভূমিকা প্রশংসনীয়। তিনি জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন নিশ্চিত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

এখানে দেশের আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদের কথা আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, যা কিনা গত কয়েক বছর ধরে দেশের সকল জনগণকে আতঙ্কিত ও চিন্তিত করে তুলেছে। এই সকল সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ধর্মের নামে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিন্তু তারা ইসলাম ধর্মসহ সকল  ধর্মের মূল ধারণাটাই ভুলে গেছে, যা হলো ‘শান্তি’। এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের ধারাবাহিক হুমকির মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে কঠোরভাবে দমনের নির্দেশ দেন এবং সফলভাবে সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করেন। তার নির্দেশে ও তত্বাবধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দ্রæত সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে, যার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ তার করাল থাবা গাড়তে পারেনি।

বাংলাদেশে এই সকল সন্ত্রাসবাদীরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে আক্রমণ করতে পারে এই ধরণের আশংকা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সন্ত্রাসবাদের প্রতি সম্পূর্ণ অসহনশীল (জিরো টলারেন্স)  নীতি গ্রহণের কারণে তারা কখনোই সফল হয়নি।

বাংলাদেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিতে ২০১৭ একটি আদর্শ বছর। মিয়ানমার থেকে আসা বিশাল নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে প্রবেশের কারণে সারা বিশ্বের চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে রয়েছে।

ছোট আয়তন, কিন্তু বিশাল জনসংখ্যা হওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এদেশে স্থান দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে প্রচুর সম্মান অর্জন করেছে। এটা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল হৃদয়ের পরিচায়ক। যেখানে তিনি মানবতার আদর্শে পরিণত হয়েছেন, সেখানে শান্তিতে নোবেল জয়ী অংসান সু চি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত গণহত্যা থেকে হাজারো রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষায় কোন ভূমিকা পালনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। সু চি তার নোবেল শান্তি পুরস্কারের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারেন নি । বিপরীত দিকে শেখ হাসিনার মহানুভবতা তাঁকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্বেও, সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের উৎসবগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করেছে। বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক কারণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও সংঘাত থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশ তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন ধরে রেখেছে। এবং অবশ্যই আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির এই ধারাকে অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাবে।

মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর: সাংবাদিক

Similar Posts