শহরবাসী বিশেষত ঢাকা শহরবাসীর দৈনন্দিন জীবন নানা বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। অনেক বিপত্তি যেমন: অসহনীয় যানজট, মাত্রাতিরিক্ত বাছুদূষণ এবং পানি দূষণের সঙ্গে শব্দ দূষণও বড় শহরগুলোতে বসবাসের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখনই ঘর থেকে বের হই তখনই সহস্র ক্ষতিকর শব্দ তরঙ্গ আমাদের ঘিরে ধরে। ঘরের ভেতরও আমরা শব্দদূষণ থেকে সুরক্ষিত নই। বিভিন্ন উৎস থেকে অস্বস্তিকর আওয়াজ ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। বায়ু দূষণ বা পানি দূষণের মতো শব্দ দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো সমন্ধে সাধারণ মানুষ খুব একটা সচেতন নন। কিন্তু এটি নানারূপ শারীরিক ও মানসিক সমস্যার প্রধান কারণ হতে পারে। শব্দের মাত্রা ডেসিবেল (ডিবি)-এ পরিমাপ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে ৬০ ডিবি মাত্রার শব্দ একজন সুস্থ্য মানুষকেও বধির করে দেয় এবং ১০০ ডিবি মাত্রার শব্দ স্থায়ী বধিরতার কারণ হতে পারে। কিন্তু ঢাকা শহরের প্রায় প্রত্যেক এলাকাতেই শব্দ প্রতিনিয়তই এই মাত্রা অতিক্রম করছে যা সুস্থ শরীর ও মন বজায় রাখার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। ঢাকার নাগরিকেরা আরো তিনভাবে যানবাহন থেকে উৎপন্ন দুর্ভোগের শিকার। প্রথমত, বিভিন্ন জেলার বাস, ট্রাক ও লরিগুলো রাতের বেলায় ঢাকার ভেতর দিয়ে চলাচল করে। কোনো বাইপাস না থাকায় ঢাকার ভেতর দিয়ে যানবাহনগুলোর অতিক্রম করা ছাড়া উপায় নেই। অত্যধিক শব্দ দূষণের কারণে রাস্তার পাশে বসবাস করা লোকজনের পক্ষে রাতে ভালোভাবে ঘুমানো সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, আমাদের শহরের ভেতর দিয়ে রেলগাড়ি চলাচল করে যা পৃথিবীর কোনো দেশেই দেখা যায় না এবং এটি শব্দ দূষণের বিরাট উৎস। তৃতীয়ত, ঢাকা শহরের ভেতরেই আমাদের প্রধান বিমানবন্দর। উড়োজাহাজগুলো সেখানে অসহনীয় শব্দ তৈরি করে। বিশেষত উড্ডয়নের সময়ে প্রচণ্ড শব্দ হয় এবং আশপাশের এলাকার লোকজন মারাত্মক শব্দ দূষণের শিকার হয়। বিশ্বের অনেক দেশে জনগণের সুবিধার্থে রাজধানীর ওপর দিয়ে রাতের বেলায় উড়োজাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু ঢাকায় সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যহত। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে পার্থক্য করা আজকাল খুব কঠিন হয়ে গেছে। বুদ্ধিহীন শহরনেতা ও রাজনৈতিক পান্ডার সহায়তায় জ্ঞানহীন ব্যবসায়ী রাঘববোয়ালেরা বহু আবাসিক এলাকাকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তরিত করে ফেলেছে এবং এর ফলে আরো বেশি জায়গায় শব্দ দূষণের মতো সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। নিরীহ নাগরিকদের ভালমন্দ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই ঢাকা শহরের বহু অভিজাত এলাকাকে উঁচু-উচু ভবন বিশিষ্ট বা বাণিজ্য এলাকায় বদলে ফেলা হয়েছে। এর ফলে ক্রমাগত উঁচু মাত্রার শব্দ ওই এলাকাগুলোর লোকজনকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে ফেলছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোসহ বেশিরভাগ দেশেই শহর এলাকার ভেতরে কোনো শিল্পস্থাপনা বা এলাকা নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে গার্মেন্টস, ট্যানারি, অটো পার্টস বা যন্ত্রাংশ, ডায়িং ফ্যাক্টরি, প্রিন্টিং প্রেস ইত্যাদিসহ শত শত শিল্প স্থাপনা ঢাকা শহরের ভেতরে অবস্থিত। এই সকল শিল্পকারখানাগুলো বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। যার ফলে উচ্চমাত্রার শব্দ উৎপন্ন হয়। এই স্থানগুলোতে যেসব মানুষ বসবাস বা চলাচল করে তাদের শব্দ দূষণের দরুণ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির শঙ্কা থাকে। হাজার হাজার শিশুরা ওই এলাকায় বসবাস করে এবং এক্ষেত্রে অনেক শিশুদের শ্রবণ-প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা সাউন্ডবক্স, মাইক্রোফোন অনেক লোকেরই বিরক্তির উদ্রেক করে এবং এটি সবচেয়ে খারাপ রূপের শব্দ দূষণ। পথচারীরা এইসব যন্ত্রের উঁচু আওয়াজে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও আমরা রিকশা, ভ্যান ও মিনিভ্যান থেকে রাস্তায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে নানা ধরণের সরকারি-বেসরকারি প্রচারণা চালাতে দেখি যেগুলো গুরুতর শব্দদূষণ করে থাকে। আজকাল রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের অঙ্গসংগঠনগলো প্রায়ই নানা মিটিং, সমাবেশ ইত্যাদিতে বিশাল মিছিল বা শোভাযাত্রা নিয়ে যোগদান করে। এসময় তারা ড্রাম বাজিয়ে, ট্রাম্পেট বাজিয়ে, বড় স্পিকারে গান বাজিয়ে একটি উৎসবের আবহ তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু এগুলো শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের শরীর ও মনে প্রচণ্ড খারাপ প্রভাব ফেলে। এছাড়াও জোরে জোরে চিৎকার, ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, সড়কে ক্যানভাসারদের প্রচারণাও নানা মাত্রায় শব্দদূষণের সৃষ্টি করছে। আমাদের শরীর, মস্তিস্ক ও মন সবকিছুর ওপরই শব্দ দূষণের প্রভাব রয়েছে। এটি উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ (বিভিন্ন অসুখের মূল কারণ), শ্রবণশক্তি হারানো, ঘুমের বৈকল্য ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। শব্দ দূষণজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড মাথাব্যাথা, বিরক্তিভাব, আতঙ্কভাব, অবসাদবোধ এবং কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়া উল্লেখযোগ্য। আজকের ঢাকা শহরে মাঝে মাঝেই শব্দদূষণের কারণে উৎপত্তি হওয়া মাত্রাতিরিক্ত উগ্রতার কারণে রাস্তাঘাটে আমরা মারাত্মক তর্কাতর্কি ও মারামারির ঘটনা দেখে থাকি। এই শব্দদূষণ আসলে আমাদের মানসিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ও আমাদের চরিত্রকে অসহনশীল করে তুলছে। শিশুরা শব্দ দূষণের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। কারণ, তারা নানা ধরণের অসুস্থতা ও বৈকল্য যেমন, মনোযোগের অভাব, খাদ্যে অনাগ্রহ ইত্যাদি শব্দদূষণের সমস্যায় সহজেই আক্রান্ত হয়। গর্ভবতী নারীরাও শব্দ দূষণের কারণে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, যে সকল সন্তানসম্ভবা মায়েরা শব্দ দূষণের শিকার হন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে, যা তাদের জীবনটাকে কঠিন দুর্যোগ ও দুর্দশার দিকে নিয়ে যায়। যদি শব্দ দূষণের সমস্যাটি এখনই সমাধানের চেষ্টা না করা হয়, তবে আজ থেকে একযুগ পর আমাদের মাঝে মারাত্মক মানসিক অসুখের অনেক লক্ষণই দৃষ্টিগোচর হবে। বাংলাদেশে শব্দদূষণকে মোকাবেলায় কিছু আইন, নিয়ম ও বিধান রয়েছে। যেমন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধান ১৯৯৭, শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ ইত্যাদি। এই আইনগুলো শব্দ দূষণের সমস্যাকে সমাধান করতে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই আইনকানুনগুলোর কদাচিৎ প্রয়োগ দেখা যায়। এই আইনগুলোর বাস্তবায়নে কোনো কঠোর উদ্যোগ দেখা যায় না। যদিও হাইকোর্ট সাম্প্রতিক সময়ে হাইড্রলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধে সরকারকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে, কিন্তু সে ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে যে কোথাও হাইড্রলিক হর্নের ব্যবহার হচ্ছে না। তাদেরকে মাইক্রোফোন, মাইক, লাউডস্পিকার ইত্যাদির ক্ষতিকর ব্যবহারকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। আবাসিক এলাকা থেকে সকল বাণিজ্যিক ও শিল্পভিত্তিক কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। বিমানবন্দরকে ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়া, আন্তঃজেলা যানবাহনগুলোর চলাচলের জন্য ঢাকার বাইরে বাইপাস তৈরি করা এবং ঢাকা শহরের ভেতর থেকে রেললাইন সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে শব্দদূষণ থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে। যদি এই সবগুলো উদ্যোগ এক সঙ্গে নেওয়া হয়, তবেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরের শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি হবে। মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর: কলামিস্ট |
মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর
Published : Sunday, 3 December, 2017 at 4:51 PM