মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর : ক্রমাগত আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও সহানুভূতি প্রকাশের পরেও মায়ানমারের চলতে থাকা সামরিক অভিযানের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে। মাত্র দুই মাসের মধ্যে এদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধনের মাধ্যমে সকল রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশ থেকে বের করে দেবার অভিযানের দরুণ প্রতিদিনই এই সংখ্যাটা মারাত্মকভাবে বাড়ছে।
এর মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার তোপ বাংলাদেশকে আঘাত করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই বিপুল শরণার্থীদের আশ্রয় দান করেছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমান খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী এই শরণার্থীদের জন্যে সংগ্রহ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নিশ্চয়তাও প্রদান করেছেন যে, কোন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্ষুধা, তৃষ্ণায় মৃত্যু বরণ করবে না।
শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে শুরু করেছে। কিস্তু সবকিছুর উপরে মায়ানমারের পক্ষ থেকে এই রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তন ও শান্তিপূর্ণ পুনর্বাসনই প্রধান উদ্বেগ হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও দু’তিন পুরুষ ধরে মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে বসবাসের পরেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার বঞ্চিত রয়েছে।
এ পর্যন্ত মায়ানমারের বৌদ্ধ-সামরিক জান্তা ও পরবর্তীতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে রোহিঙ্গাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। ২০১৫ সালে মায়ানমারের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসী (এনএলডি) ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন আশা করেছিল কিন্তু তাদের নেই আশা অধরাই থেকে গেছে।
আর্মি ও তাদের সহযোগী বৌদ্ধদের চোখ এড়িয়ে রোহিঙ্গারা বর্ডার অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে এবং অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। এই বিপর্যয়কে জাতিসংঘের মহাসচিব জাতিগত নিধন বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং সারাবিশ্ব একে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা বা জেনোসাইড হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মায়ানমার প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্ত খোলা রাখার এবং আর্মি ও সীমান্ত রক্ষীদের কোন প্রকার কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশের কারণে এখনও প্রতিদিন নাফ নদী দিয়ে হাজারও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এটি ছিল শেখ হাসিনার একটি দৃষ্টান্তপূর্ণ মানবিক সিদ্ধান্ত। তাঁর এই যুগান্তকারী উদারতা তাঁকে মানবতার মাতার সম্মানজনক উপাধি এনে দিয়েছে এবং বিশ্ব নেত্ববৃন্দকে রোহিঙ্গাদের সাহাযার্থে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। একই সাথে মায়ানমারকে এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্যেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ চাপ প্রয়োগ করছে যা এখন নেপিদো-কেই সমাধান করতে হবে।
মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আর্মি ও সহযোগী বৌদ্ধদের রোহিঙ্গাদের উপরে নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। যদিও জাতিসংঘ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত মায়ানমারকে তার সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত পাঠাবার চাপ প্রয়োগে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চলতে থাকা চলমান সমস্যায় জাতিসংঘের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র যেমন; চীন, রাশিয়া এবং ভারত মায়ানমারের পক্ষ নিচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এই রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশেবিভিন্ন উদ্দেশ্যের প্রতি সমর্থনশীল হিসেবে পরিচিত।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলেন। এরই প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক সম্প্রদায়গুলো তাদের সাহায্যার্থে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসে। এই মানুষগুলোর প্রতি সকলে সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও কিছু বিশেষ সমস্যা এখনও সমাধান হওয়ার বাকী। কারণ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল হওয়ার পরেও এতো বিপুল জনগোষ্ঠীকে বেশীদিন ভরণ-পোষণ করার বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
রোহিঙ্গাদের সাথে মায়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিবাদের ইতিহাস অনেক পুরোনো। চল্লিশের দশকে এর সূত্রপাত ঘটে- যদিও অনেকের মতে এর মূল আরও গভীরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা মিত্র (ব্রিটিশ) বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। এর বিনিময়ে তারা একটি নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসিত সীমানা ছিল রাখাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। সে সময় ব্রিটিশ বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গারা জার্মানির নাজি বাহিনী ও জাপানি জ্যাপ বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎকালীন বার্মায় লড়েছিল। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বার্মায় জাপানি সেনাদের হাতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তখন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকেছিল। রোহিঙ্গারা জাপানিজ জ্যাপ বাহিনীর পক্ষে থাকা স্থানীয় বৌদ্ধদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের হাতে কয়েক সহস্রাধিক বৌদ্ধ মারা পড়ে। এর মধ্যে দিয়ে দু-পক্ষের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি হয়।
সামরিক সরকারের অধীনে ও তত্ত্বাবধানে ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা শুরু হয়। তখন বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৮২ সালে এবং ৯০-এর দশকের প্রথম ভাগেও একই ধরণের অভিযান চলে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। সর্বশেষ এই বছরের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে সামরিক বাহিনী ও সহযোগী বৌদ্ধদের অত্যাচারে নিপীড়িত লাখ লাখ রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নিতে শুরু করে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্য বর্তমানে প্রায় জনশূন্য হয়ে গিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, গত ১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিং অন হ্লাইয়াং বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেই কাজে সফল হতে পারেননি, এখন তারা তাতে সফল হয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে রাখাইন রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আয়ত্বে আনতে ব্যর্থতা এবং বর্তমানে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য সফল হওয়াকেই ইঙ্গিত করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মায়ানমারের সেনাপ্রধান ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে খ্যাত অং সান সু চি উভয়েই তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে অ্যাখ্যায়িত করেন।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পরে মায়ানমারের সদ্য গঠিত ইউনিয়ন গভর্মেন্ট অব মায়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৮০-এ দশকে সামরিক সরকার তাদের জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। একই সাথে সামরিক জান্তা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়ণ করতে শুরু করে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মায়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি দাবি করছে অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি ‘বাঙালি’ইস্যু। আর এই সত্য প্রতিষ্ঠায় একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এরপর গত ১২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান বলেন, তারা কোনোভাবেই মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। নথিপত্র প্রমাণ করে, তারা কখনো রোহিঙ্গা নামেও পরিচিত ছিল না। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই তারা বাঙালি ছিল।
কিন্তু তাদের এই বক্তব্য যে মিথ্যাচার তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মায়ানমারের সংসদে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য ছিলেন যারা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। ১৯৪৭ সালে মংদো, বুথিদোং থেকে যথাক্রমে নির্বাচিত সুলতান আহমেদ ও এম এ গাফ্ফার নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে মংদো থেকে জুরা বেগমসহ পাঁচজন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে ছয় জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কয়েক যুগ পরে ১৯৯০-এর নির্বাচনে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ফর হিউম্যান রাইটস্ –এর চারজন রোহিঙ্গা সদস্য সংসদে নির্বাচিত হন। এরা হলেন- শামসুল আনোয়ারুল হক, নুর আহমেদ, চিত লুইন এব্রাহিম এবং ফাজাহ আহমেদ। এদের মধ্যে সুলতান মাহমুদ ১৯৬০-৬২ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমারের “নৃগোষ্ঠী” হিসেবে অস্বীকার করাটা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যাচার।
কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির বক্তব্য ছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ভরা। তিনি সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংকে ছাড়িয়ে এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চাই।
মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি এবং সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংয়ের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মায়ানমারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। আর অনিশ্চিত হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন।
একথা সত্য যে, রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে কিছু বিদ্রোহ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মায়ানমারের সামরিক সরকার কর্তৃক যে ভয়াবহ বর্বরোচিত হামলা চালোনো হয়েছে তার সাথে কোনো নৃশংসতারই তুলনা হয় না। এর ফলে ৮০-এর দশকে ও ৯০-এর দশকে বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা নিরূপায় হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
চরম নির্যাতিত এই রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তারা সকলেই অশিক্ষিত। তাদের খুব দ্রুত সময়ে মায়ানমারে ফিরে যাবার সম্ভাবনাও খুব কম। যেহেতু এই মানুষগুলোকে মায়ানমারের সামরিক সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই তারা মৌলিক এবং মানবিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত ছিল। এরা কয়েক পুরুষ ধরেই শিক্ষা বঞ্চিত এবং এই কারণেই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বিশ্বের অন্য সকল শরণার্থীদের থেকে চরিত্রগতভাবে আলাদা।
আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা শঙ্কাজনকভাবে অশিক্ষিত। তাদের মধ্যে অল্পকিছু শুধুমাত্র কিছু ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ করেছে তা ও তাদের ঘরে এবং গোপনে। স্কুলের শিক্ষা লাভের কোনো সুযোগ তাদের ছিল না, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা।
যেহেতু তারা অশিক্ষিত, সেহেতু তাদেরকে বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশে কর্মসংস্থান করা খুবই কঠিন হবে; যা তাদেরকে একটি বিশাল বোঝায় পরিণত করবে। তার উপরে ক্ষুধা ও দারিদ্রের হাত থেকে মুক্তি পাবার নিমিত্তে এই লোকগুলোকে খুব সহজেই অবৈধ কাজের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
একই সাথে মায়ানমারের স্বাস্থ্যসেবায় এই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অনেক অবহেলা ছিল। বিধায় তাদের অনেকেই অসুস্থ। অমানুষিক নির্যাতনের দরুণ তাদের অনেকেরই স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি শারীরিকভাবে তাদেরকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সর্বোপরি হাজার হাজার ধর্ষিত গর্ভবতী মহিলা থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ শারীরিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। আর এই সমস্যাগুলো রোহিঙ্গাদের কর্মদক্ষতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের এই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ব্যাপক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা প্রদান করতে হবে।
শত শত ক্যাম্পের অস্থায়ী ঘরে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন সংস্থা, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি খাদ্য, পানি, তাঁবু, ওষুধপত্র ও অর্থের রূপে সাহায্য প্রেরণ করছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই সাহায্যগুলো তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে যথেষ্ট নয়। তার জন্য খাদ্য ও আশ্রয়স্থলের পাশাপাশি শিক্ষা এবং বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।
আমরা দেখেছি যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কিছু মাদ্রাসা খোলা হয়েছে এবং আমরা এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আমরা একই সাথে উদ্বিগ্ন। কারণ, যারা এই মাদ্রাসাগুলো পরিচালনা করছে তাদের উদ্দেশ্য আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। এটা সম্ভব যে, তারা তাদের ছাত্রদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে যা আমরা গত কয়েক বছরে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটতে দেখেছি।
এ ছাড়াও আইএসআইএস, নব্য জেএমবি ইত্যাদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত মানুষজনকে ভুল ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সন্ত্রাসবাদের দিকে টেনে আনতে টার্গেট করে থাকে। তাই এই রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে।
এই রোহিঙ্গাদের মাঝে শিশু-কিশোররাই সংখ্যা গরিষ্ঠ এবং তাদের বেশীরভাগই পিতা-মাতাহীন বা অনাথ। উন্নয়নের রোহিঙ্গাদের আধুনিক শিক্ষা ও সুবিধাসহ স্কুল প্রয়োজন। তাদের শিক্ষাটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজী বা বার্মিজ ভাষায় হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু, তাদেরকে মায়ানমারে ফিরে যেতে হবে।
তাদের শিক্ষাক্রমে বাংলায় কোনো পড়াশোনা থাকা উচিত নয়। কিছু বেসরকারি সংস্থা যেমন, ব্র্যাক বাংলা পাঠ্যক্রম নিয়ে কিছু স্কুল চালু করেছে। কিন্তু এখনই ইংরেজী বা বার্মিজ ভাষায় পরিবর্তন করা প্রয়োজন। যদি তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করা যায় তবে শুধু রোহিঙ্গারাই নয় বরং অদূর ভবিষ্যতে মায়ানমারও লাভবান হবে।
আমাদের কখনোই ভোলা উচিৎ হবে না যে, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আনান কমিশনের পরামর্শানুযায়ী দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন। ইউএনএইচসিআর এবং জাতিসংঘের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের উচিৎ বাংলাদেশ সরকার ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সাহায্য নিয়ে রোহিঙ্গাদের স্কুলের জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করা। আর আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোকে এই শরণার্থীদের জন্য শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্কুল স্থাপন ও আনুষঙ্গিক কার্যকমে বিনিয়োগ করতে হবে। যদি তাদেরকে শিক্ষিত করা সম্ভব হয় তবে এই রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার রক্ষায় শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে এবং মায়ানমারের জন্য সম্পদে পরিনত হবে।
এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য যথাযথ চিকিৎসা সেবা ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে, যার জন্যে আন্তর্জাতিক দাতাদের এবং ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফ এর মতো জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন গুলোকে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকবার জন্য তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যাগুলোকে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
যদি যথার্থ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সম্ভব হয়, তবে এই রোহিঙ্গাদের ভাগ্য অদূর ভবিষ্যতে পরিবর্তন হবে। শিক্ষা ব্যতীত শুধুমাত্র খাদ্য ও বাসস্থানের মাধমে তারা কখনো তাদের এই অমানবিক অবস্থা থেকে বের হতে পারবে না এবং সর্বদাই অবদমিতই রয়ে যাবে।
সবচাইতে জরুরি এই যে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই শরণার্থীদের মৌলিক অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে এবং কঠোরভাবে এই রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনকে সমর্থন করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা তৈরি করতে শুরু করেছে।
এই তালিকাটি বাংলাদেশ সরকারকে একই সাথে ইউএনএইচসিআর এর মাধ্যমে অনুমোদন ও প্রত্যায়ন করে নিতে হবে। কারণ, মায়ানমার এই তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারে, যা তারা আগেও করেছে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলাদেশে এবং তাদের মাতৃভূমি মায়ানমারে যেন রোহিঙ্গারা তাদের সকল মানবিক অধিকার লাভ করতে পারে সে লক্ষে আমাদের সকলকেই, সারা বিশ্বকেই এক সাথে কাজ করতে হবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, মোহাম্মদী নিউজ এজেন্সী (এমএনএ)